রাসেল ভাইপার কামড়ালে কি হয় এবং কামড়ালে প্রাথমিকভাবে কি করণীয়?
আপনারা কি জানতে চাচ্ছেন যে রাসেল ভাইপার কামড়ালে কি হয় এবং কামড়ালে প্রাথমিকভাবে কি করণীয়?। রাসেল ভাইপার কামড়ালে কি মানুষ বাঁচে? ও রাসেল ভাইপার কামড়ের চিকিৎসা কি?। তাহলে অযথা চিন্তাভাবনা না করে এই আর্টিকেলটি মনোযোগ সহকারে পড়ুন।
কারণ এই আর্টিকেলটি যদি আপনি মনোযোগ সহকারে পড়েন তাহলে আরো জানতে পারবেন রাসেল ভাইপার সাপের অ্যান্টিভেনম সম্পর্কে। রাসেল ভাইপার সাপের ইতিহাস এবং রাসেল ভাইপার সহ বাংলাদেশের বিষধর সাপের তালিকা।
ভূমিকা
রাসেল ভাইপার মারাত্মক বিষধর সাপ হিসেবে সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে পরিচিত। তাই আমরা আজকের এই আর্টিকেলটিতে রাসেল ভাইপার সম্পর্কে আপনার মনের মধ্যে জাগ্রত হওয়া সকল প্রশ্নের উত্তর নিয়ে আলোচনা করেছি। আমাদের আলোচ্য বিষয়গুলো হলো- রাসেল ভাইপার কামড়ালে কি হয় এবং কামড়ালে প্রাথমিকভাবে কি করণীয় এছাড়াও আমরা আলোচনা করেছি রাসেল ভাইপার সাপের এ্যান্টিভেনম সম্পর্কে।
আরো আলোচনা করা হয়েছে রাসেল ভাইপার কামড়ালে মানুষ কি বাঁচতে পারে? রাসেল ভাইপার বাংলাদেশের কোথায় কোথায় বেশি পাওয়া যায় এবং রাসেল ভাইপার সাপের ইতিহাস সম্পর্কে। তাহলে চলুন জেনে নেয়া যাক রাসেল ভাইবার সাপ সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য।
রাসেল ভাইপার সাপের ইতিহাস|রাসেল ভাইপার কি
রাসেল ভাইপার সাপের ইতিহাস বলতে গেলে একজন মানুষের নাম সামনে চলে আসে আর তিনি হলেন স্কটিস সার্জন প্যাট্রিক রাসেল। প্যাট্রিক রাসেল ছিলেন মূলত একজন বিখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ। স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গে ১৭২৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারিতে প্যাট্রিক রাসেল জন্মগ্রহণ করেন। রোমান ও গ্রীক ক্লাসিকে পড়ালেখা সমাপ্ত করেন এডিনবার্গ হাইস্কুল থেকে।
এরপর তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেডিসিন সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করেন আলেকজান্ডার মনরোর অধীনে এবং ১৭৫০ সালে বিখ্যাত মেডিসিন বিশেষজ্ঞ হিসেবে স্নাতক পদক লাভ করেন এই স্কটিস সার্জন । ১৭৮১ সালে পরে প্যাট্রিক রাসেল ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাকৃতিক ইতিহাস অধ্যায়ন করার জন্য ভারতে যান।
আর তখন কর্নাটকে অবস্থিত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে কর্মরত শ্রমিকরা সাপের উপদ্রপে অনেক আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল কারণ অনেক শ্রমিক সাপের কামড়ে মারা যাচ্ছিল। তখন প্যাট্রিক রাসেল বিষাক্ত সাপ এবং বিষ ছাড়া সাপ চিহ্নিত করার জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন। আর তিনি এ সকল পরীক্ষা মুরগি ও কুকুরের উপর করার পর সাপের বিষের তীব্রতা এবং স্বল্পতা বর্ণনা করেছিলেন এবং সাপগুলোকে বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত করেছিলেন।
প্যাট্রিক রাসেল যে সকল সাপকে বিষধর হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন তার মধ্যে একটি হল(katuka Rekula Poda)যার কামড়ে মৃত্যুও হতে পারে। যেহেতু প্যাট্রিক রাসেল তার গবেষণার মাধ্যমে এই সাপকে বিষাক্ত হিসেবে প্রমাণ করেছিলেন ১৭৯৬ সালে তার প্রকাশিত বই "An Account of Indian Sarpents Collected On The Coast Of Coromandel" বই এর মধ্যে এবং এই বইয়ের খন্ড ছিল দুইটি।
প্রথম খন্ডটি ৪৪টি প্লেটে প্রকাশিত হয় ১৭৯৬ সালে এবং দ্বিতীয় খন্ডটি চারটি ভিন্ন ভিন্ন অংশে বিভক্ত ছিল যার প্রথম দুইটি ১৮০১ সালে এবং পরের দুইটি ১৮০২ সালে প্রকাশিত হয়। তাই প্যাট্রিক রাসেলের নাম অনুসারে এই প্রজাতির সাপকে রাসেল ভাইপার নামে নামকরণ করা হয়েছে।
রাসেল ভাইপার কামড়ালে কি হয় এবং কামড়ালে প্রাথমিকভাবে কি করণীয় এ সম্পর্কেও তিনি তার বইয়ে আলোচনা করেন। এছাড়াও রাসেল ভাইপারের মত দেখতে আরো একটি প্রজাতি রয়েছে যার নাম(Daboya Ruseli)। এছাড়াও রাসেল ভাইপার সাপটি চন্দ্রবোড়া ও উলুবোড়া নামেও অনেকটা পরিচিত স্থানীয় লোকদের কাছে।
রাসেল ভাইপার কামড়ালে কি হয়?
সারা বিশ্বের বিষধর সাপগুলোর মধ্যে অন্যতম বিষধর সাপ হলো রাসেল ভাইপার। এই প্রজাতির সাপের মধ্যে রয়েছে অনেক তীব্র মাত্রার বিষ যা খুবই অল্প সময়ের মধ্যে একজন মানুষ বা প্রাণীর মৃত্যু ঘটাতে পারে। কারণ একটি অল্প বয়স্ক রাসেল ভাইপার সাপ তার কামড়ের সাথে প্রায় ৮ থেকে ৯ মিলিগ্রাম পর্যন্ত বিষ ঢালতে পারে। একটি পূর্ণবয়স্ক রাসেল ভাইপার সাপ তার ছোবলের সঙ্গে সঙ্গে প্রায় ১২৫ মিলিগ্রাম থেকে ২৪০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত বিষ ঢালতে পারে।
যার ফলে যেকোনো প্রাণীর মৃত্যু অনিবার্য যদি কামড়ানো ব্যক্তিকে দ্রুত চিকিৎসার আওতায় না আনা হয়। রাসেল ভাইপার সাপের ছোবল এবং দংশনের ধরন অন্যান্য বিষধর সাপের তুলনায় সম্পূর্ণ আলাদা। রাসেল ভাইপার সাপ যখন কোন একজন ব্যক্তিকে কামড় অথবা ছোবল দেয় তখন সেই ব্যক্তির দেহে বিভিন্ন ধরনের জটিলতা ও সমস্যা দেখা দেয়। রাসেল ভাইপার কামড়ালে কি হয় এবং কামড়ালে প্রাথমিকভাবে কি করণীয় এই আর্টিকেলটির মধ্যে এখন আমরা সেই সমস্যা গুলো তুলে ধরব।
রাসেল ভাইপার সাপ যখন কোন একজন ব্যক্তিকে ছোবল দেয় তখন তীব্র বিষক্রিয়ার প্রভাবে সেই ছোবলে জায়গাটুকু অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই লালচে কালো বর্ণ ধারণ করে এবং পুরো জায়গাটি ফুলে তীব্র ব্যথার সৃষ্টি হয়। আর সেই কামড়ানো অংশে ধীরে ধীরে পচন ধরে।
রাসেল ভাইপার কামড়ানো ব্যক্তির কিডনি ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় ফলে কিডনি অকেজো হয়ে পড়ে। এছাড়াও দেহের স্নায়ুগুলো অবস হওয়ার ফলে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে।
রাসেল ভাইপার কামড়ানো ব্যক্তির রক্ত ধীরে ধীরে জমাট বাঁধে। কারণ রাসেল ভাইপারের বিষ রক্তের লোহিত কণিকা গুলোকে নষ্ট করে দেয় এবং রক্ত চলাচলকে ব্যাহত করে ফলে রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করে।
রাসেল ভাইপার কামড়ানো ব্যক্তি রক্তচাপ কমে যায় এবং হৃদস্পন্দন ধীরে ধীরে কমতে থাকে। তাই সঠিক সময়ে চিকিৎসা না নিলে রোগীর মৃত্যু হতে পারে।
রাসেল ভাইপার কামড়ানো ব্যক্তির দেহে যখন বিষক্রিয়া আস্তে আস্তে ছড়াতে থাকে তখন সেই ব্যক্তি ধীরে ধীরে চোখে ঝাপসা দেখতে শুরু করে এবং এক পর্যায়ে চোখ বন্ধ হয়ে যায়।
রাসেল ভাইবার কামানো ব্যক্তি বাহ্যিক রক্তক্ষরণ দেখা দিতে পারে যেমন প্রস্রাবে, দাঁতের মাড়িতে এবং থুথুতে রক্তক্ষরণের লক্ষণ দেখা দিতে পারে।
এছাড়াও রাসেল ভাইপার সাপ কামড়ালে সাধারণ কিছু লক্ষণ দেখা যায় যেমন বমি বমি ভাব, প্রচন্ড মাথাব্যথা মাথাঘোরা, দেহ থেকে ঘাম ঝরা এবং কামড়ানো ব্যক্তি দুর্বল হয়ে পড়া ইত্যাদি।
রাসেল ভাইপারের বিষে কি আছে | সাপের বিষের নাম কি?
রাসেল ভাইপার কামড়ালে কি হয় এবং কামড়ালে প্রাথমিকভাবে কি করণীয়? এই আর্টিকেলটিতে এখন আমরা আলোচনা করব সাপের বিষ সম্পকে। ভাইপার সহ বিভিন্ন প্রজাতির বিষধর সাপের মধ্যে কয়েক ধরনের বিষ বিদ্যমান থাকে প্রথমটি হলো নিউরোটক্সিন আর দ্বিতীয়টি হলো হেমোটক্সিন এবং তৃতীয়টি হলো মায়োটক্সিন।
নিউরোটক্সিনঃ নিউরোটক্সিন বিষ দেহের ভিতরে থাকা স্নায়ুতন্ত্র গুলোকে সরাসরি অ্যাটাক করার মাধ্যমে দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলোকে প্যারালাইসিস ও নিস্তেজ করে দেয়। এ ধরনের বিষ পোস্টসিন্যাপটিক এবং প্রিসিন্যাপটিক নিউরোটক্সিন এর সমন্বয়ে তৈরি হয় যা দেহের কোষগুলোর সংযোগস্থলকে আক্রমণ করে এবং বিচ্ছিন্ন করে দেয়। কামড়ানো জায়গা হালকা লালচে কালো বর্ণ হয়ে ফুলে ওঠে এবং প্রচন্ড ব্যথা হয়।
হেমোটক্সিনঃ হেমোটক্সিন বিষ দেহ এবং ত্বকের টিস্যুগুলোকে নষ্ট করে। এছাড়াও রক্তের ভিতরে থাকা লোহিত রক্তকণিকা গুলোকে ধ্বংস করার মাধ্যমে রক্ত পরিবহন ব্যবস্থাকে বাধা দেয় এবং দেহের ভিতরে রক্তক্ষরণ ঘটায়। এছাড়াও দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো নিষ্ক্রিয় এবং নিস্তেজ হয়ে যায় হেমোটক্সিন বিষের প্রভাবে।
মায়োটক্সিনঃ মায়োটক্সিন দেহের মাংস পেশিগুলোকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়। এতে মাংস পেশিগুলো অল্প সময়ের মধ্যে সংকুচিত হয় এবং সম্পূর্ণ দেহে ব্যথার সৃষ্টি করে। এছাড়াও যেসব মাংসপেশি শ্বাসতন্ত্রকে স্বাভাবিক রাখে সেগুলো ঠিক মত কাজ করা বন্ধ করে দেয়। ফলে দম বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
রাসেল ভাইপার কামড়ের প্রাথমিক চিকিৎসা ও করণীয়
রাসেল ভাইপার একটি বিষধর সাপ। এই সাপ কামড়ানো ব্যক্তি বা ভুক্তভোগীকে অতি দ্রুত চিকিৎসকের আওতায় নিতে হবে এবং সঠিক চিকিৎসা প্রদান করতে হবে। তবে রাসেল ভাইপার সাপ কামড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ভুক্তভোগীর জন্য প্রাথমিক কিছু করণীয় বা চিকিৎসা রয়েছে। যেগুলো অনুসরণ করলে দেহে দ্রুত বিষ ছড়িয়ে পরে না এবং ভুক্তভোগী অনেকক্ষণ সুস্থ থাকে।
তাই আমাদের প্রত্যেকের জানা উচিত রাসেল ভাইপার কামড়ালে কি হয় এবং কামড়ালে প্রাথমিকভাবে কি করণীয়। রাসেল ভাইপার কামড়ালে কি হয় এ সম্পর্কে আমরা জেনেছি। আর এখন আমরা জানব রাসেল ভাইপার কামড়ালে প্রাথমিকভাবে করনীয় চিকিৎসা সম্পর্কে। চলুন তাহলে জেনে নেওয়া যাক।
- বিষধর সাপে কামড়ানো ভুক্তভোগী অনেক বেশি আতঙ্কিত থাকে তাই প্রথমত ভুক্তভোগীর মনে সাহস জোগাতে হবে যে সাপে কামড়ালে এখন আর মানুষ মরে না সঠিক চিকিৎসার মাধ্যমে সাপে কামড়ানো ব্যক্তি সুস্থ হয়ে যায় এভাবে বোঝাতে হবে। যাতে সে আতঙ্কিত না হয়।
- সাপ কামড়ানো ভুক্তভোগীকে বেশি নড়াচাড়া বা হাঁটাচলা করতে দেয়া যাবে না। কারণ বেশি নড়াচাড়া করলে মাংসপেশিগুলো সংকুচিত হয় ও দেহে রক্তচাপ বেড়ে যাবে এবং বিষ দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে।
- সাপ কামড়ানো অংশটুকু পানি অথবা স্যাভলন দিয়ে খুবই আলতো ভাবে ধুয়ে অথবা মুছে নিতে হবে।
- সাপ কামড়ানো স্থানটুকু হালকা কোন কাপড় বা ব্যান্ডেজ দিয়ে আলতো করে পেঁচিয়ে রাখতে হবে যাতে ধুলোবালি ক্ষত স্থানে না পড়ে।
- সাপ কামড়ানো ভুক্তভোগির গায়ে টাইট কোন বস্তু যেমন ঘড়ি অথবা আটো-শাটো পোশাক থাকলে তা দ্রুত খুলে ফেলতে হবে। নাহলে দেহে দ্রুত বিষ ছড়িয়ে পড়বে
- সাপ কামড়ানো ভুক্তভোগীকে নিরবে দাঁড়িয়ে অথবা বসে থাকতে হবে। কোন অবস্থাতেই ভুক্তভোগীকে শুয়ে থাকতে দেয়া যাবে না। এতে বিষ দ্রুত ছড়াতে পারে।
- সাপের দংশিত স্থানে কোন অবস্থাতেই ধারালো কোন বস্তু, কাঠি, সুই ইত্যাদি দিয়ে খোচানো যাবে না। এছাড়াও ওই ক্ষত স্থানে কোন কিছু প্রলেপ বরফ অথবা কোন কিছু প্রয়োগ করা যাবে না চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া।
- সাপ কামড়ানো ভুক্তভোগীকে ওঝার কাছে নিয়ে গিয়ে সময় নষ্ট না করে নিকটস্থ স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্র, ক্লিনিক অথবা মেডিকেলে দ্রুত নিয়ে যেতে হবে।
- রাসেল ভাইপার সাপ কামড়ানো স্থানের উপরে অথবা নিচে দড়ি বা ফিদা দিয়ে কোন অবস্থাতেই বাঁধা ও গিট দেয়া যাবে না। কারণ এতে করে বাঁধা বা গিট দেয়া স্থানে অভ্যন্তরী রক্তক্ষরণ হয়ে অঙ্গহানি হতে পারে।
- এদেশে একটি কুসংস্কার প্রচলিত আছে যে সাপে কামড়ানো স্থানে মুখ লাগিয়ে টানলে সাপের বিষ বের হয়ে যায়। এটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণ যা কখনোই করা যাবে না।
- যেহেতু সাপে কামড়ানো স্থানে প্রচুর ব্যথা হয় তাই ভুক্তভোগীকে সোডিয়ামের মত কোন ধরনের ব্যাথা নাশক ঔষধ খাওয়ানো যাবে না। এতে করে ভুক্তভোগীর রক্তক্ষরণের আশঙ্কা বারে।
রাসেল ভাইপার সাপের বিষের এন্টিভেনম
রাসেল ভাইপার কামড়ালে কি হয় এবং কামড়ালে প্রাথমিকভাবে কি করণীয়? বিষয় নিয়ে লেখা আর্টিকেলটিতে এবারে আলোচনা করব সাপের বিষের এন্টিভেনম সম্পর্কে। সাপের বিষে বিষক্রিয়াকে ধ্বংস করার জন্য যে উপাদান ব্যবহার করা হয় তাকে এ্যান্টিভেনম বলে। অন্যান্য সাপের বিষের যেমন এ্যান্টিভেনম রয়েছে ঠিক তেমনি রাসেল ভাইপার বা চন্দ্রপোড়া সাপের বিষেরো এ্যান্টিভেনাম (vaccine) রয়েছে। আর এসব এ্যান্টিডোট বা এ্যান্টিভেনম গুলো সারা দেশের সরকারি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে পর্যাপ্ত পরিমাণে মজুদ রয়েছে।
এছাড়াও ঢাকার ইনস্টিটিউট অফ পাবলিক হেল মেডিকেল থেকেও এই এ্যান্টিভেনম গুলো সংগ্রহ করা যায়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশের টক্সিকোলজি সোসাইটির সভাপতি এম এ ফায়েজ তার লিখিত বইয়ে উল্লেখ করেন যে গোখরো সাপ কামড়ালে ৮ ঘণ্টার মধ্যে, কেউটে সাপ কামড়ালে ১৮ ঘণ্টার মধ্যে এবং রাসেল ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া কামড়ালে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে ভুক্তভোগীকে এ্যান্টিভেনম না দিলে মৃত্যুর ঝুঁকি বারতে পারে।
তাই সাপে কামড়ানো ভুক্তভোগীকে বাড়িতে না রেখে অতি তাড়াতাড়ি নিকটস্থ হাসপাতাল বা ক্লিনিকে নিয়ে যাওয়ার পর নিদৃষ্ট সময়ে মধ্যেই পর্যায়ক্রমে এই এ্যান্টিভেনম গুলো ভুক্তভোগী শরীরে ইন্জেকশনের মাধ্যমে পুশ করলে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে। কিন্তু যদি নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে যায় তার পর এই এ্যান্টিভেনম ভ্যাকসিন ভুক্তভোগী শরীরে কাজ করবে না।
এছাড়া গবেষকরা বলেছেন যে অনেক সময় এ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করা ১০ থেকে ৬০ মিনিট পর বিভিন্ন ধরনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় যেমন বমি হওয়া, মাথাব্যথা, জ্বর আসা, শ্বাসকষ্ট, কাশি চুলকানি, ত্বকে লাল লাল চাক হওয়া, বুক ধরফর করা ইত্যাদি।
রাসেল ভাইপার কামড়ালে কি মানুষ বাঁচে?
বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষের সঠিক ধারণা না থাকার কারণে তারা রাসেল ভাইপারের মত সকল সাপকে বিষাক্ত মনে করে এবং এবং আরো একটি ভুল ধারণা রয়েছে যে সাপে কামড়ালে মানুষের মৃত্যু হয়। গবেষণা থেকে জানা যায় বাংলাদেশে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ প্রজাতির সাপ আছে এগুলোর মধ্যে প্রায় ২৭ প্রজাতির সাপ সামুদ্রিক।
আর বাকিগুলো স্থল ভাগে বসবাস করে যেগুলোর অধিকাংশ সাপের মধ্যে কোন বিষক্রিয়া নেই তাই এগুলো কামড়ালে মানুষের কোন ক্ষতি হয় না। টক্সিকোলজি সভাপতি ডক্টর এম এ ফয়েজ বলেছেন বাংলাদেশ প্রায় ৬ থেকে ৮ প্রজাতির বিষধর সাপ রয়েছে তার মধ্যে (রাসেল ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া, উলুবড়া)একটি।
এছাড়াও রয়েছে (কোবরা বা গোখরো, শঙ্খচূড়া)(কেউটে বা ক্রেইট, বাঙ্গারাস)(সবুজ বড়া বা গ্রিন ভাইপার, গাল টাউয়া, পিঠ ভাইপার)। এই চার প্রজাতির সাপের বিষক্রিয়া তীব্র হওয়ায় এগুলো কামড়ালে মানুষের শরীরে বিভিন্ন ধরনের জটিলতা দেখা দেয় এবং মৃত্যু ঝুঁকিও রয়েছে অনেকে আবার মারাও যায় সঠিক চিকিৎসার অভাবে।
তবে ভয়ের কোন কারণ নেই বর্তমানে বাংলাদেশে এ সকল বিষধর সাপে বিষে এ্যান্টিভেনম ভ্যাকসিন রয়েছে। সাপে কামড়ানো ব্যক্তির দেহে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এই এ্যান্টিভেনম ভ্যাকসিন প্রয়োগ করলে অল্প সময়ের মধ্যে সাপে কামড়ানোর ব্যক্তি সুস্থ হয়ে যায়।
বাংলাদেশের বিষধর সাপের তালিকা
বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার আনাচে কানাচে প্রায় আশি প্রজাতির সাপ দেখতে পাওয়া যায়। এগুলোর মধ্যে প্রায় সাত থেকে আট প্রজাতি সাপ অত্যান্ত বিষধর। আর এই সকল বিষধর সাপ কামড়ালে মানুষের জটিলতা এবং মৃত্যুও হতে পারে। তাই এই বিষধর সাপগুলো চিনে রাখা এবং এগুলো সম্পর্কে প্রত্যেকের ধারণা থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যাতে প্রত্যেকে বুঝতে পারে যে কোন সবগুলো বিষধর এবং কোন সপগুলো বিষধর নয়। তাহলে চলুন জেনে নেই বাংলাদেশের বিষধর সাপগুলো সম্পর্কে
(king kobra)শঙ্খচূড়াঃ কিং কোবরাকে বাংলায় রাজ গোখরা বা সাংকচূড়া বলা হয়। বিষধর এই সাপটি আকৃতিতে অনেক লম্বা এবং মোটা হয়ে থাকে এর দেহে সাদা ও কালো ডোরাকাটা দাগ রয়েছে এবং ফনার মধ্যে চশমার ফ্রেমের মত কালো বলয় রয়েছে। বিষধর এই সাপটি পাহাড়ি এলাকা এবং ঘন জঙ্গলে বেশি দেখতে পাওয়া যায়। বিষধর কিং কোবরা বাংলাদেশ, ভারত থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ফিলিপাইন, নেপাল, ইন্দোনেশিয়া, চীন, কলম্বিয়া, বার্মা, ভুটান ইত্যাদি দেশগুলোতে বেশি দেখা যায়।
শঙ্খিনী বা ক্রেইটঃ সারা পৃথিবীতে মোট আটটি প্রজাতি রয়েছে ক্রিয়েট বা শঙ্খিনী জাতের সাপের। এই আর্ট প্রজাতির মধ্যে মাত্র পাঁচ জাতের সাপ বাংলাদেশের দেখতে পাওয়া যায়। এটিকে শাঁকিনী নামে ডাকার হয় পাশাপাশি এটি কেউটে নামে অনেক পরিচিত। শঙ্খিনী প্রজাতির সাপ বাড়ির আশেপাশে জঙ্গলে, লাকড়ির স্তূপের মধ্যে এবং শুকনো জায়গায় বেশি দেখা যায়।
কালো নাইজারঃ কালো নাইজার সপটিও শঙ্খিনী প্রজাতির সাপ। এইসাপটি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও সিলেটের পাহাড়ী অঞ্চলে, নোয়াখালী এবং সুন্দরবন অঞ্চলে প্রচুর দেখতে পাওয়া যায়।
গ্রীন ভাইপারঃ গ্রীন ভাইপার বা বাংলায় সবুজবোড়া নামের এই সাপটি স্থানীয়ভাবে গাল টাউয়া নামে পরিচিত। এই সাপের মাথার অংশ মোটা তাই এরকম নামকরণ করা হয়। গ্রীন ভাইপার জাতের অনেক প্রজাতির সাপ রয়েছে এরমধ্যে মাত্র ছয় প্রজাতির সাপ বাংলাদেশের দেখতে পাওয়া যায়। সবুজ বোড়া সাপ সুন্দরবন এলাকার অঞ্চল এবং পাহাড়ি অঞ্চলের জঙ্গলগুলোতে থাকে। এই সাপ মানুষের মাথায় মুখে এবং গায়ে ছোবল দেয়। এই সাপের কামড়ে স্নায়ু মাংসপেশি এবং মস্তিষ্ক নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় এবং দেহের অভ্যন্তরীণ রক্তপাত হয়।
নায়া কাউচিয়াঃ নায়া কাউচিয়া সাপটিকে স্থানীয়ভাবে জাতি বা জাত সাপ এবং জোউড়া নামেও ডাকা হয়। এই সাপটিও গোখরা প্রজাতির সাপ। এই সাপ রাগান্বিত হলে ফনা তোলে। নায়া কাউচিয়া সাপটি বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চল যেমন নোয়াখালী, সিলেটে বেশি চোখে পড়ে।
নয়া নয়াঃ কোবরা এবং গোখরা প্রজাতির এই সাপটির বৈজ্ঞানিক নাম হলো নয়া নয়া। এই সাপটি দেশের পশ্চিমাঞ্চল অর্থাৎ রাজশাহীতে বেশি দেখতে পাওয়া যায়।
রাসেল ভাইপারঃ বাংলাদেশে যত ধরনের বিষাক্ত সাপ দেখা যায় তারমধ্যে সবচেয়ে বিপদজনক সাপ হচ্ছে রাসেল ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া। এই সাপটি অত্যন্ত ক্ষিপ্র মেজাজের। এই সাপটি প্রায় ৯০ থেকে ১০০ বছর পূর্বে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ থেকে কিন্তু আবার গত ১০ থেকে ১২ বছর যাবত বিভিন্ন সময়ে এইসাপটি কামড়ানোর ঘটনার প্রমাণ পাওয়া যায়। বর্তমানে বাংলাদেশে এই রাসেল ভাইপার খুবই আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। প্রথমে রাসেল ভাইপার রাজশাহীতে দেখা গেলেও এখন এটি ফরিদপুর সহ দেশে ৩৫টি থেকে ৪০টি অঞ্চলে বিস্তার লাভ করেছে। কিন্তু হঠাৎ করে কেন এইসব বাংলাদেশে এত বেশি দেখা যাচ্ছে এ নিয়ে গবেষণা চলছে।
লেখকের শেষ কথা
এতক্ষণ আমরা জানলাম যে রাসেল ভাইপার কামড়ালে কি হয় এবং রাসেল ভাইপার কামড়ালে প্রাথমিকভাবে কি করণীয় চিকিৎসা এবং আরো জেনেছি রাসেল ভাইপার সাপের অ্যান্টি ভেনাম সম্পর্কে। সাপে কামড়ানো ব্যক্তির জন্য আমার পরামর্শ হলো ভুক্তভোগীকে খুব দ্রুত চিকিৎসার আওতায় নিয়ে আসতে হবে এবং তার সঙ্গে এমন কিছু করা যাবে না যাতে চিকিৎসার জন্য ভুক্তভোগীকে হাসপাতালে বা ক্লিনিকে নিয়ে যেতে দেরি হয়। একটা কথা মাথায় রাখতে হবে যে সাপে কামড়ানো ব্যক্তিকে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে অন্যথায় ভুক্তভোগী বিপদ বাড়তে পারে।
আশা করি আপনারা বুঝতে পেরেছেন যে রাসেল ভাইপার সাপের ভয়ে আতঙ্কিত না হয়ে প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। আপনারা যদি এই আর্টিকেলটি পড়ে উপকৃত হয়ে থাকেন এবং এরকম তথ্যমূলক আর্টিকেল পড়তে আগ্রহী থাকেন তাহলে অবশ্যই আমাদের ওয়েবসাইটটি প্রতিনিয়ত ভিজিট করবেন। এতক্ষণ আমাদের সঙ্গে থাকার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। রাসেল ভাইপার সাপ কোন দেশের। বাংলাদেশের বিষধর সাপের তালিকা। রাসেল ভাইপার সাপ কোন কোন জেলায়।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url